
কলমে: তুলি গুহ
আমার জীবনের প্রিয় নারী আমার মা, আমার ১৭ বছরের কন্যা সন্তান - তিতলি। না এমন নয় যে তারা আমার খুব কাছের জন বলেই তারা আমার খুব প্রিয়; তাদের জন্য জীবনের এমন অনেক ঘটনা বা কারণ তৈরি হয়েছে বলেই তারা আমার সত্যিই খুব প্রিয়।
কিন্তু এখানে আমি তাদের কথা লিখছি না। লিখব আমার জীবনের আরও এক প্রিয় শ্রদ্ধেয়া নারী - আমার দিদি শাশুড়িকে নিয়ে। উনি বড্ড ভালোবাসতেন আমায়। তবে আমার বিয়ের পর মাত্রই ঠিক দুটো বছর ওনাকে আমি কাছে পেয়েছি।
দিদা অর্থাৎ দিদি শাশুড়ি থাকতেন দর্জিপাড়ায়। দর্জিপাড়ায় দিদার নিজের এক ছেলে, ছেলের বউ অর্থাৎ আমার মামা মামিমা এবং তাদের মেয়ে ছাড়াও আরো অনেকে থাকতো।
এখানে দিদার সম্পর্কে একটু বলে নিই। খুব অল্প বয়সেই, প্রায় ২৬ বছর বয়সে দিদা তার স্বামীকে হারান। দিদার ছিল এক ছেলে এবং চার মেয়ে। তবে এই এত অল্প বয়সে স্বামীকে হারানোয়, তার মানসিক ক্ষতে কিছুটা প্রলেপ দেওয়ার উদ্দেশ্যে সেই সময় তার মাথার উপর যে গুরুজনরা ছিলেন তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে দিদাকে দৈনন্দিন সংসারের কাজে জড়াবেন না। হাতেকলমে সূচীশিল্প শেখার জন্য দিদাকে তারা একটি ভালো স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন এবং দিনে দিনে সূচীশিল্পকে তিনি অসম্ভব ভালোবেসে ফেলেছিলেন। হয়তো সেই শিল্পের মধ্যে ডুবে থেকে তিনি তার মনের খালি জায়গাটা ভরাট করতে পেরেছিলেন। নিজেকে এই সূচীশিল্পের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে নিয়েছিলেন, নিয়মিত অভ্যাসে ওনার হাতের কাজ হয়ে উঠেছিল অসম্ভব সুন্দর।
ভালোবাসা তো জীবনে অনেক মানুষের কাছ থেকে পেয়েছি কিন্তু কেন জানিনা এই দিদা আমার মনের সবটুকু যেন কেড়ে নিয়েছিলেন। ওই যে বললাম আমায় বড্ড ভালোবাসতেন উনি। তার একদম হৃদয়ের অন্তরস্থল থেকে বেরিয়ে আসা নির্ভেজাল ভালোবাসা দিয়েই উনি আমাকে ছুঁয়ে ছিলেন।
১৯৯৬ সাল। তখন আমার নতুন বিয়ে। দর্জিপাড়ায় গেলেই উনি আমার শাড়ি, গয়না এতটা মমতা, স্নেহের সাথে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে দেখতেন...
না, না হয়ত একটু ভুল বললাম; উনি দেখতেন আমি কতটা সেজেছি, আমাকে কতটা মিষ্টি লাগছে। খুব আদর করতেন আমাকে। আর সব সময় হাসতেন। আমার হাতের চুড়ি সরিয়ে সরিয়ে দেখতেন যে হাতে কি কি পড়েছি, শাড়িতে হাত বুলিয়ে দিতেন, আমার গায়ে হাত বুলিয়ে দিতেন। কত দামী জিনিস পরেছি সেটা ওনার কাছে ম্যাটার করত না; আমি পড়েছি, আমি সেজেছি এটাই ওনার কাছে ম্যাটার করত।
আমাকে কাছে পেয়ে উনি যেন বড্ড বেশি খুশি হয়ে পড়তেন। ওনার ঠাকুর ঘরে আমার জন্য চন্দ্রপুলি রাখা থাকতো কারণ উনি জানতেন ওই মিষ্টিটা আমার পছন্দের মিষ্টি ছিল।
লিখতে গিয়ে একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। আমরা অনেক সময়েই মামার বাড়িতে বেড়াতে যেতাম। দিদার সাথে দেখা করতে যাওয়া একটা প্রধান উদ্দেশ্য অবশ্যই। দিদা থাকতেন তিনতলায়। বয়সজনিত কারণে ওনাকে তিনতলা থেকে নামতে দেওয়া হতো না। তো আমিও মামার বাড়িতে গেলে দিদার ঘরে ঢুকে আর বের হতাম না, দিদার পাশেই বসে থাকতাম। মামার মেয়ে আমার থেকে ছোট হলেও আমাদের দুজনের খুব ভালো বন্ধুত্ব ছিল, এখনও আছে। তো এরকমই একদিন মামার বাড়িতে গিয়ে তিনতলায় না উঠে দোতলায় ননদের সাথে গল্প করতে বসে গিয়েছিলাম। গল্প করতে করতে কখন সময় কেটে গেছে, দিদা তিনতলা থেকে দোতলায় নেমে এসেছে। আমি তো অবাক হয়ে গেছি।
ওমা তুমি কেন নেমে এসেছ!! আমি তো যাবো উপরে...
কি সুন্দর অপরূপ একটা স্বর্গীয় হাসি হেসে দিদা আমাকে বলল, তুমি তো গেলে না তাই আমি নেমে এলাম। দিদার এই কথায় আমি সেদিন খুব লজ্জা পেয়েছিলাম। কতখানি ভালোবাসা মমতার টান তৈরি হয়েছিল সেই টান থেকে আজও নিজেকে মুক্ত করতে পারিনি।
নাতির থেকেও নাত বউ যেন ওনার বেশি প্রিয়, বেশি আদরের ছিল। আমার বিয়ের মাত্র দু'বছর পরেই, তখন ওনার বয়স ৮৫ বা ৮৬ হবে, ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে উনি মারা যান।
খুবই কষ্ট পেয়ে উনি মারা যান। কিন্তু কিছুতেই নিজের মৃত্যু পূর্ব যন্ত্রণা প্রকাশ করতেন না। যেদিন চলে গেলেন তার আগের দিনও তাঁকে ইনজেকশন দেওয়ার জন্য নার্স তার শরীরে শিরা খুঁজে পাচ্ছিল না। একবার এদিক একবার ওদিক ফুটিয়ে ফুটিয়ে শিরা খুঁজে বার করার চেষ্টা করছিল। দেখছিলাম ওনাকে.. চোখ বুজে, ঠোঁট কামড়ে কি অপরিসীম সহ্য শক্তি।
একটা অদ্ভুত ঘটনার কথা বলি। উনি চলে যাওয়ার বেশ কয়েক বছর পরে মামার বাড়িতে মিস্ত্রি লাগার কারণে ঘরদোর থেকে বেশ কিছু পুরনো জিনিস বেরিয়েছিল। তার মধ্যে ছিল দিদার একটা ট্রাংক। তাতে দিদার হাতের কাজের অনেক জিনিস ছিল। সৌভাগ্যবশত সেই সব জিনিস থেকে দিদার হাতে করা এক অপূর্ব সুন্দর কাঁথা যা এখনকার দিনে অ্যান্টিক, আর ওনার হাতে করা একটা ছোট্ট ফ্রক আমার হাতে এসে পৌঁছেছিল। অবাক হয়ে দেখেছিলাম, যে ফ্রকটা পেলাম সেটা তো উনি বহু বছর আগে মানে ওনার কম বয়সে করেছিলেন, তা সত্ত্বেও সেটা একটুও নষ্ট হয়নি। আমার মেয়ের জন্য দিদা এভাবেই একটা উপহার আগেভাগেই বানিয়ে রেখেছিলেন (ভাবতে কি অদ্ভুত লাগে তাইনা। যে সময় উনি এই ফ্রকটা বানিয়েছিলেন সে সময় তো এই পৃথিবীতে তাঁর নাতি অর্থাৎ আমার বেটার হাফের আসতে তখন অনেক বছর দেরি)। আমার মেয়ে তার ঐ ছোট্ট বয়সে বড়মার থেকে পাওয়া এই অমূল্য উপহার পেয়ে না বুঝেই যেন ধন্য হল। ওই ফ্রকটা আমার ছোট্ট মেয়েকে পড়িয়ে আমার মনে হয়েছিল ওর জীবনের চলার পথে এ এক বিরাট বড় আশীর্বাদ। সেই দুটো জিনিস যেন আমার জীবনের অনেক বড় উপহার বা বলা ভালো সারপ্রাইজ গিফট।
একেই মনে হয় বলে ভালোবাসার টান, না হলে ওনার হাতে করা সেই জিনিসগুলো এমনভাবে আমার হাতেই বা এসে পড়লো কি করে !!
আজও চোখ বুঝলে ওনাকে খুব কাছ থেকে অনুভব করতে পারি। বয়স হয়ে গেলে মানুষের শরীরে আর তেমন সৌন্দর্য থাকে না। কিন্তু আমার এই দিদা ওই বয়সেও খুব সুন্দরী ছিলেন, খুব সুন্দর করে উনি হাসতে পারতেন। তা থেকেই বোঝা যায় অল্প বয়সে দিদা কি অসামান্য সুন্দরী ছিলেন। আসলে ওনার মনটাই এতটা সুন্দর ছিল যে সেটাই বাইরে প্রকাশ পেত।
আজকের দিনে বিভিন্ন সংসারে আমরা দেখতে পাই ছেলের বিয়ে দিয়ে তার মা কেমন যেন আশঙ্কায় থাকে সংসার থেকে তার কর্তৃত্ব হারানোর ভয়ে। অথচ ওই অত বছর আগে পুরনো আমলের ওই মানুষটি ছেলের বিয়ে দিয়ে সেই ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে যাননি। উল্টে দিব্যি হাসিমুখে নিজের সংসারের চাবিকাঠি বৌমার হাতে তুলে দিতে পেরেছিলেন। উনি বেঁচে থাকলে আজ প্রশ্ন করতাম তোমার কি সংসারে অপাঙ্তেয় হবার একটুও ভয় করেনি? ঠিক কোন বিশ্বাসের জোরে কোনও কারণ ছাড়াই ছেলের বউকে এত অধিকার দিয়ে দিলে! সংসারের সব ভার এক লহমায় ছেড়ে দিতে পারলে!!
আমার জীবনে আমার দেখা সেরা নারী এবং সেরা সুন্দরী আমার এই দিদাটির নাম শ্রীমতি পরিমল রাণী নাগ।
দিদাকে আমার আদর ভালোবাসা আর প্রণাম জানাই।
©️ তুলি গুহ