
গান্ধার শিল্পে বুদ্ধমূর্ত্তি বিশেষ ভাবে আকর্ষনীয়। এই মূর্ত্তিগুলি সাধারণ-ধ্যানমগ্ন ও শিক্ষাদানে চিত্রিত হয়। বুদ্ধের মুখবয়বে শান্তি ও মঙ্গলভাব প্রকাশ প্রায়। বস্ত্রের ভাঁজ অত্যন্ত সূক্ষভবে খোদিত হয়, যা গ্রীক ও রোমান মিল্পের ত্রুটি।
ভাস্কর্য্যে বিস্তারিত বিবরণীতে অলংকরণ অর্থাৎ অলংকার ব্যাবহার দেখা যায় যা শিল্পীদের সমর্থন এবং সূক্ষতার পরিচায়ক।
পাথর, চুন বালি বা প্লাস্টার অফ প্যারিস, পোড়া মাটি দিয়ে মূর্ত্তি গঠন করাখলে হতো। মূর্ত্তিগুলিতে স্থানীয় বৈশিষ্ট্য দানের জন্য গোঁফ বা পাগড়ী পরানো হতো। এমনকি বুদ্ধ মূর্ত্তিতে গোঁফ দেখা যায়। যক্ষ, গরুর, প্রভৃতির মূর্ত্তি গ্রীক জিউস, ব্যাকাস প্রভৃতির অনুকরণে তৈরী করা হতো। বিমারান অঞ্চলে পাওয়া বৌদ্ধ মূর্তিগুলির বৈশিষ্ট্য গুলি কাঁধের উত্তরীয় প্রভৃতি দেহ হতে স্বতন্ত্রভাবে দেখানো হয়েছে।
উত্তরীয়ের নীচে দেহের অংশ প্রস্ফুটিত। উত্তরীয়ের ভাঁজগুলি আন্দোলিত। মুর্ত্তিগুলির ওপর সোনালী বা ধূসর রঙের গাঢ় প্রলেপ দিয়ে পরবর্তী কালে পালিশ করা হয়ে থাকতো।
গান্ধার ভার্ভে বুদ্ধের জীবনের বিভিন্ন চিত্রায়ন দেখা যায়। যেমন জন্ম, নির্বান এবং ধর্ম চক্র বর্তমান। এখানে চিত্রকর্মের বেশির ভাগই পশ্চিমা ধ্রুপদী শৈলীর সাথে স্পষ্টভাবে সম্পর্কিত। এই সময়ে গান্ধার অঞ্চলে করিন্থীয় স্তম্ভের মত ভূমধ্যসাগরীয় ধ্রুপদী স্থাপত্য গুলি চার পাঁচশ বছর ধরে জনপ্রিয় ছিল। হেলেনেস্টিক গ্রীকদের উপর নির্ভরশীল প্রাথমিক পণ্ডিতরা গান্ধারে আখ্যান এবং প্রতীকী চিত্রগুলিতে বুদ্ধের নৃতাত্ত্বিক চিত্রের উত্থানের সাথে সম্পর্কিত।
এই বৈশিষ্ট্য গুলি গান্ধার বৌদ্ধ ভাস্কর্য্য ও চিত্রায়ন কে অনন্য করে তোলে। এটি প্রাচীন শিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
মথুরা এবং গান্ধার প্রায় সমকালীন। গান্ধার শিল্পের বিকাশের সঙ্গে মথুরার একটি যোগসূত্র লক্ষ্য করা যায়। মথুরার বিস্তার হয়েছিল গঙ্গার তীরে এবং এর পরিধি ছিল পূর্বভারত পর্যন্ত। দুটি স্থানের শিল্পের মধ্যেই অনেকখানি সাম্য লক্ষ্য করা হয় তবে গান্ধারের যে পরিমাণে হেলেনিক প্রভাব ছিল তার তুলনায় মথুরার ভাস্কর্য্যে আমরা হেলেনেস্টিক উপাদানের সঙ্গে ভারতীয় ধারনার সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়। দুটি শিল্পের মধ্যে সাম্য এখানেই যে দুটি যায়গাতেই বুদ্ধকে আরাধ্য ঈশ্বর হিসাবে দেখা হয়েছিল এবং বৌদ্ধ মূর্ত্তি লক্ষনের মূল উদাহরণ গুলি এখানেই দেখা যায়। এ ছাড়াও দুটি জায়গাতেই ভাস্কর্য্যের সাধারনভাবে জীবনের বর্ণনা রয়েছে। তবে মথুরায় গান্ধারের তুলনায় স্থাপত্য ধর্মী ভাস্কর্য্য কম পাওয়া যায়। মথুরায় স্থাপত্যের ভগ্নাবশেষ এর মধ্যে রয়েছে নারী মূর্তি উৎকিরণ স্তম্ভ। এই নারীমূর্ত্তি গুলি অতিশয় অলংকৃত। নারীর অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কে এগুলিতে অতিরঞ্জিত করা হয়েছে । মথুরায় আর একটি বৈশিষ্ট্য হল যে এখানে জৈন ধর্মের প্রচার ছিল এবং জীনের সর্বত্র ভাত্রিকা মূর্ত্তি পাওয়া গেছে। সবদিকে তিনি অবলোকন করেছেন এই মূর্ত্তি খোদাই করে রাখা আছে। মথুরাতে জৈন সর্বতভদ্র মূর্ত্তি বোধন পাওয়া গেছে।
হেলেনিক শব্দের অর্থ গ্রীক দেশের শিল্পকলা সহ যাবতীয় সংস্কৃতি এবং গ্রীসের বাইরে গ্রীকদের সম্রাজ্য কিংবা গ্রীক প্রভাবে নির্মিত শিল্পকলা। গ্রীক ন্যাচারালিজমের সঙ্গে পূর্ব দেশীয় আইডিয়ালিজম এর অভূতপূর্ব সমন্বয় ঘটেছিল। এরই প্রভাব দেখা যায় গান্ধার শিল্প কলার বুদ্ধ মূর্ত্তিতে। গান্ধারের শিল্পীরা বুদ্ধের রূপকল্পনায় গ্রীক ও রোমান মূর্ত্তিকলার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। বুদ্ধের আমরা প্রথম মানব রূপে দেখি। কুষাণ আমলের একটি স্বর্ণমুদ্রায় বুদ্ধের মাথার পিছনে জ্যোতি দেখানো হয়েছে। মূর্ত্তিটি দণ্ডায়মান অবস্থায় দেবতার মত দেখানো হয়েছে। এই স্বর্ণমুদ্রার রোমান ক্ষুদ্র খোদাই রিলিফে আমরা বুদ্ধমূর্ত্তির আইকনোগ্রাফি প্রথম দেখতে পাই। প্রথম মূর্ত্তির লক্ষন হোলো ইলিশ উষ্ণীশ যা ছিল আধ্যাত্মিক জ্ঞানের প্রতীক। ঝোলানো কানের লতি যার দ্বারা বোঝা যায় যে তিনি রাজপুত্র থাকাকালীন ভারী গহনা কানে পরতেন। উত্তলিত ডান হাতে অভয় মুদ্রা, সন্ন্যাসীর অঙ্গ বস্ত্র এবং মাথার পিছনে মহিমা দত্তক জ্যোতি। এই বিবরণ অনুসারে পরবর্তীকালে দেশে দেশে অসংখ্য বুদ্ধমূর্তি তৈরী হয়েছিল। গান্ধার শিল্পের গুরুত্ব এইখানেই যে সর্বপ্রথম মানবরূপে দেবতা বুদ্ধকে কল্পনা করা হয়েছে। পরবর্তী কালে সমস্ত বৌদ্ধ শিল্পের বুদ্ধ মূর্ত্তির লক্ষন ও রূপ এখন? কল্পনার জন্য গান্ধারের কাছে ঋণী।
হোতি মার্দান নামক বর্তমানে পাকিস্তানের একটি জায়গায় যে গান্ধার বুদ্ধমূর্তিটি পাওয়াগেছে তাতে বুদ্ধকে রাজরূপ দেবতার মত দেখানো হয়েছে। দেহে রাজোচিত পোষাক এবং দেহ ভঙ্গি রোমান রাজাদের মত। তার মাথায় উষ্ণীশ এবং ভ্রূর মাঝখানে ঊর্না দিয়ে বোঝানো হয়েছে যে এটি বুদ্ধের মূর্ত্তি। Stucco মাধ্যমে তৈরী বুদ্ধের একটি মাথায় আমরা যেন গ্রীক দেবতা অ্যাপোলো কেই দেখতে পাই।
গান্ধারের মূর্ত্তিকলার মাধ্যমছিল পাথর বা Stucco, এই পাথর ছিল নীলচে বা কালচে ধূসর জাতীয় পাথর। প্রথমদিকের অধিকাংশ মূর্ত্তি ছিল পাথরে কাটা। শেষের দিকে Stucco তেও মূর্ত্তি তৈরী হোতো গদের আঁঠা এবং পশুর লোম দিয়ে। এইগুলি একসঙ্গে মিশিয়ে প্লাস্টারের মত ব্যাবহার করাহয়।
এগুলোর ছাঁচে ফেলে স্থাপত্যের জন্য Stucco তে অলংকরণ করা হয়। Stucco শব্দটি এসেছে প্রাচীন জার্মান Sukki শব্দ থেকে। এর অর্থ দল বা পিণ্ড। ইটালীয়ান এ Stucco অর্থ হল প্লাস্টার।
হোতি মাদানে যে মূর্তিটি পাওয়া গেছে, সেই মুর্তিটির মাথাটি ইসৎ হেলানো মুখমণ্ডল অত্যন্ত কমনীয় অজন্তার পদ্মবানী ও অবলোকিতস্বরের কথা মনে করিয়ে দেয়। এই মুখটিতে ন্যাচারালইজম্ এর সঙ্গে ভারতীয় সৌন্দর্য্যের চেতনার সমন্বয় ঘটানো হয়েছে। ধনুকের মত ভ্রূ যুগল পদ্মের পাপড়ির মত চোখ এবং ডিমের মত সুডৌল মুখ আমরা লক্ষ্য করে থাকি।
৪৩″ উঁচু একটি বুদ্ধ মূর্ত্তিতে আমরা বুদ্ধকে রাজপুরুষের মত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। রাজার মত গোঁফ দেখানো হয়েছে। তার পায়ে রোমান চপ্পল গায়ে রাজোচিত গহনা মাথার উপরে ফিতে দিয়ে উষ্ণীশ বাঁধা কিন্তু তার গায়ের পোশাকের কাজগুলি নকশার মত করে সাজানো।
এই মূর্ত্তিটি প্রমান করে যে হেলেনিক মডেল কিভাবে ক্রমে ভারতীয় ভগবানের দ্বারা সম্পূর্ণ একটি ভিন্নরূপ গ্রহন করেছিল। গান্ধার মূর্ত্তিকলায় অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এইযে বুদ্ধের রূপ কল্পনায় শিল্পীরা করেছেন অন্যান্য শাস্ত্রের মধ্যে আদর্শ ধাপে পাননি। কারণ, ঋগবেদের দেবীরা ছিলেন কাল্পনিক পক্ষান্তরে গ্রীকীয় নিখুঁত মানুষের অবয়বেই দেবতার ররূপ কল্পনা করেছিলেম। তাই বুদ্ধের মত একজন ঐতিহাসিক পুরুষের রাপক কল্পনায় গ্রীক দেবতার মডেলটি বৌদ্ধ শিল্পীদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল।
শিল্পে-ভারত ও গান্ধার
মালা ভট্টাচার্য্য
০৪/৩/২০২৫